ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখ হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠেছে। একসময় কাশ্মীরের অংশ থাকা অঞ্চলটিকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে কয়েকদিন ধরে চলা আন্দোলন বুধবার (২৪) সেপ্টেম্বর) প্রাণঘাতী সংঘাতে রূপ নিয়েছে। সেখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জারি হয়েছে কারফিউ। এই প্রেক্ষাপটে আলোচনায় এসেছেন ম্যাগসেসে পুরস্কারপ্রাপ্ত লাদাখের শিক্ষাবিদ ও পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুক। আমির খান অভিনীত ব্লকবাস্টার ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমার ‘র্যাঞ্চো’ চরিত্রের মূল প্রেরণা যিনি। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার মনে করছে, লাদাখে এখনকার যে পরিস্থিতি এর জন্য দায়ী ওয়াংচুক। এজন্য তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বৈদেশিক অনুদান সংক্রান্ত একটি অভিযোগের তদন্তও শুরু করেছে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআই। এমনকি ওয়াংচুকের স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ বা ‘সেকমল’র নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। ফলে বিদেশ থেকে আর কোনো তহবিল গ্রহণ করতে পারবে না এই দাতব্য প্রতিষ্ঠান।
ওয়াংচুকের জীবনী থেকে প্রেরণা নিয়ে বানানো সিনেমা ‘থ্রি ইডিয়টস’র মুক্তির পর পাহাড়ি অঞ্চল লাদাখে তার প্রতিষ্ঠিত স্কুল পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়। দীর্ঘদিন সমাজ ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করলেও ৫৯ বছর বয়সী ওয়াংচুক ২০১৯ সাল থেকে লাদাখের ভঙ্গুর পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় হন। উন্নয়ন ও পর্যটনের নামে নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংসের প্রতিবাদে একাধিকবার অনশন করে সচেতনতা সৃষ্টি ও সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। ধীরে ধীরে প্রচলিত রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রভাবকে ছাড়িয়ে সাধারণ লাদাখিদের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন সোনম ওয়াংচুক। এমনকি দাবি আদায়ে দিল্লি অভিমুখেও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। এর ধারাবাহিকতায় লাদাখের আলাদা রাজ্যের মর্যাদা আদায়ে তার নেতৃত্বে গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ জন অনশন শুরু করেন, তাদের মধ্যে দুজনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় ২৩ সেপ্টেম্বর। তারপরই ‘লাদাখ এপেক্স বডি’র যুব সংগঠন হরতালের ডাক দেয়, যেখান থেকে সহিংসতা হয়।
বিবিসির খবর অনুসারে, অনশন চলাকালে একটি অনলাইন সংবাদ সম্মেলন করে সোনম ওয়াংচুক বলেন, ৭২ বছর বয়সী তে্সরিং ওয়াংচুক এবং ৬০ বছর বয়সী তাশি ডোলমার শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়েছে, তাদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। এই ঘোষণার পর আন্দোলনকারীরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে এবং আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। ওয়াংচুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তিনি উত্তেজনা সৃষ্টি করতে আরব বসন্তের মতো আন্দোলনের প্রসঙ্গ এনেছেন এবং নেপালের জেন-জির বিক্ষোভের কথাও বলেছেন। ২৪ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ ওয়াংচুকের উত্তেজক ভাষণে উত্তেজিত হয়ে অনশনস্থল থেকে বেরিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের দফতর এবং কিছু সরকারি দফতরে হামলা চালানো হয়।
এদিকে সহিংসতার পরে সোনম ওয়াংচুক তার অনশন আন্দোলন তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন এবং যুবসমাজের প্রতি ভাঙচুর না করার আবেদন জানান। তিনি বলেন, যুবসমাজ সহিংসতা বন্ধ করুক, কারণ এতে আমাদেরই আন্দোলনের ক্ষতি হবে, পরিস্থিতির অবনতি হবে। এই শিক্ষাবিদ ও পরিবেশকর্মী বলেন, লাদাখে গণতন্ত্র নেই এবং সাধারণ মানুষের কাছে এই অঞ্চলকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেটাও পূরণ করা হয়নি।
উত্তরপূর্বের ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম আর আসামের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোর জন্য সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল কার্যকর। এই তফসিল অনুযায়ী প্রশাসন, রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের ক্ষমতা, স্থানীয় প্রশাসন পরিচালন ব্যবস্থা, বিকল্প বিচার ব্যবস্থা ও স্বায়ত্তশাসিত পরিষদের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষমতা দেওয়া হয়ে থাকে। বিবিসি বাংলা বলছে, ২৪ সেপ্টেম্বর পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে অন্তত চার জনের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও ৫৯ জন। সংঘাতের প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে কারফিউ জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে চলছে গণগ্রেপ্তার। ধরা হয়েছে অর্ধশত বিক্ষোভকারীকে।
লাদাখে ১৯৮৯ সালের পরে এত বড় সহিংসতা এই প্রথম দেখা গেল। সেখানকার প্রধান শহর লেহতে কারফিউ বাস্তবায়নে পুলিশের পাশাপাশি আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন হয়েছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, পরিস্থিতি সমাধানে লেহতে একজন ‘বিশেষ দূত’ পাঠিয়েছে নয়াদিল্লি। অন্যদিকে অঞ্চলের লেফটেন্যান্ট গভর্নর কোবিন্দর গুপ্তর সভাপতিত্বে একটি নিরাপত্তা পর্যালোচনা সভা হয়েছে, যেখানে শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। কোবিন্দর গুপ্ত সংঘাতের ঘটনাটিকে ‘ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে বলেন, এখানে পরিস্থিতির অবনতি যারা ঘটাচ্ছে, তাদের আমরা ছাড়ব না।
চীন লাগোয়া লাদাখ অঞ্চলটি আগে ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যেরই অন্তর্গত ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা–৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করে নেওয়ার সময়েই লাদাখকে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বলে ঘোষণা করা হয়।
#এম_এস